সাইবার ক্রাইম (cybercrime) বা ডিজিটাল অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সিকিউরিটি অ্যাক্ট।

Published: 2021-04-18 07:30:00

আমাদের দেশে ডিজিটাল অপরাধ নিয়ে তদন্ত, অপরাধের বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ এবং সর্বোপরি অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনার জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তি আইনের (আইসিটি অ্যাক্ট) বহুল আলোচিত ৫৭ ধারাসহ কয়েকটি ধারা বাতিল করে নতুন এ আইনের খসড়া সংসদে উঠেছে। ৯ এপ্রিল ২০১৮ ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল-২০১৮’ সংসদে উত্থাপন করেন। বিলে বলা হয়েছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল ২০১৮’ শীর্ষক ওই বিলে বলা হয়েছে , কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের বাইরে এই আইনের অধীন কোনও অপরাধ করেন, যা বাংলাদেশে করলে এই আইনের অধীনে যোগ্য হয়, তাহলে এই আইনের বিধান এমনভাবে প্রযোজ্য হবে, যেন ওই অপরাধ বাংলাদেশেই সংঘটিত হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনটি কার্যকর হলে ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বিলুপ্ত হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ওই ধারাগুলোর অধীনে ইতিমধ্যে দায়েরকৃত মামলা বিচারাধীন থাকলে তা চলমান থাকবে। প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার জন্যে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু সম্প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে তা হলে ওই ব্যক্তির সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। একই অপরাধ একাধিকবার করলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের জেল বা ২০ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালের আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্ধুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া হয়, তাহলে এ কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট পাস হলে যেসব দণ্ড প্রযোজ্য হবে-

১. এ আইন পাস হলে হ্যাকিং, ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার’  রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিপন্ন করতে বা ভয়ভীতি সৃষ্টির জন্য কম্পিউটার বা ইন্টানেট নেটওয়ার্কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং ডিজিটাল উপায়ে গুপ্তচরবৃত্তির মতো অপরাধে ১৪ বছরের কারাদন্ডের পাশাপাশি কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড দেওয়া যাবে।

২. ইন্টারনেটে কোন প্রচার বা প্রকাশের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধে আঘাত করার শাস্তি হবে ১০ বছরের জেল, ২০ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড। সংসদে উত্থাপিত বিলে যেসব শাস্তির কথা বলা হয়েছে – ১. যদি কোন ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোন ধরনের অপপ্রচার চালান বা তাতে মদদ দেন, তাহলে ১৪ বছরের কারাদন্ড, এক কোটি টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড হবে। ২. কম্পিউটার বা ডিজিটাল ডিভাইসে বেআইনি প্রবেশের ক্ষেত্রে একবছরের জেল, তিন লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বেআইনি প্রবেশে সহযোগিতা করলে তিন বছরের কারাদন্ড, ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড দেওয়া যাবে।

৩. কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম থেকে কোন উপাত্ত, উপাত্ত ভান্ডার বা তথ্য বেআইনিভাবে সংগ্রহ বা স্থানান্তর করলে বা কোন উপাত্তের অনুলিপি বেআইনিভাবে সংগ্রহ করলে সাত বছরের কারাদন্ড অথবা ১০ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড দেওয়া যাবে। কম্পিউটার সোর্স কোড ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস বা পরিবর্তন করলে তিন বছরের জেল বা তিন লক্ষ টাকা জরিমানা করা যাবে।

৪. কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রচার করেন বা করান যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে, অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তাহলে তার  ৭ বছরের কারাদন্ড, ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে।

৫. যদি কোন ব্যক্তি ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে জালিয়াতি করেন, তাহলে পাঁচ বছরের কারাদন্ড, পাঁচ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন। ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ব্যবহার করে প্রতারণা করলেও একই দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

৬. রাষ্ট্রীয় অক্ষতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করা বা জনগণ বা কোন অংশের মধ্যে ভয়ভীত সঞ্চার করার উদ্দেশ্যে কেউ কোন কম্পিউটার  নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে বৈধ প্রবেশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে বা বেআইনি প্রবেশ করলে বা তাতে সহযোগিতা করলে তিনি সাইবার সন্ত্রাসের অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবেন। সেজন্য তার ১৪ বছরের কারাদন্ড, এক কোটি টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড হতে পারে।

৭. ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে কেউ যদি ওয়েবসাইট বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক বিন্যাস এমন কিছু প্রচার বা প্রকাশ করেন বা করান যা ধর্মীয় অনুভূতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, হাতলে তাকে ৭ বছরের জেল ও ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড দেওয়া হবে।

৮. যদি কোন ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনি ডিভাইস দিয়ে ফৌজদারি দন্ডবিধির ৪৯৯ ধারার আওতাধীন কোন মানহানিকর অপরাধ করেন, তাহলে তিন বছরের কারাদন্ড বা ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে।

৯. ওয়েবসাইট বা কোন ইলেকট্রনিক যন্ত্র দিয়ে ‘আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক’ তোন তথ্য পাঠালে তিন বছরের কারাদন্ড বা তিন লক্ষ টাকা জরিমানা করা যাবে।

১০. গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বেআইনি প্রবেশের জন্য সাত বছরের জেল, ২৫ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড দেওয়া হবে। বেআইনি প্রবেশ করে ক্ষতিসাধন বা নষ্ট বা অকার্যকর করলে বা সেই চেষ্টা করলে ১৪ বছরের কারাদণ্ড, এক কোটি টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড দেওয়া যাবে। 

১১. যদি কোন ব্যক্তি হ্যাকিং করেন তাহলে ১৪ বছরের কারাদন্ডসহ ১ কোটি টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন।

১২. কোন সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপীয় তথ্য উপাত্ত যদি কেউ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, ডিজিটালনেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ করেন, প্রেরণ করেন বা সংরক্ষন করেন, তাহলে তা গুপ্তচারবৃত্তির অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। আর এ জন্য ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লক্ষ টাকা জরিমান করা যাবে।

১৩. কোন ব্যাংক, বীমা বা আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে কোন ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আইনানুগ কর্তৃত্ব ছাড়া অনলাইন লেনদেন করলে ৫ বছরের কারাদণ্ড, ৫ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।

 

সমালোচনায় ৩২ ধারা- ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের  খসড়াটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর থেকে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে পড়ে। সাংবাদিকরাও প্রস্তাবিত আইনটির ৩২ ধারায় সমালোচনা করছেন। এই আইনের ফলে প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ হবে বলে অনেকেই মনে করছেন। ওই ধারায় সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনে তথ্য উপাত্ত, যেকোন ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছরের কারাদন্ড ও ২০ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বিলটি আনার উদ্দেশ্য- বিলটি আনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপকল্প, ২০২১- ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির  সর্বোচ্চ ও নিরাপদ ব্যবহার আবশ্যক। বর্তমান বিশ্বে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে এর সুফল ভোগের পাশাপাশি অপপ্রয়োগও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃ্দ্ধি পাচ্ছে। সাইবার ক্রাইমের কবল থেকে রাষ্ট্র এবং জনগণ ও তাদের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান এ আইনের অন্যতম লক্ষ্য ।  বাংলাদেশ সরকার বলছেন যে বাক স্বাধীনতা বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধা দেয়া এই আইনের উদ্দেশ্য না। বরং সাইবার ক্রাইম দমনই হচ্ছে এর একমাত্র প্রধান উদ্দেশ্য।



There are no comments yet.
Authentication required

You must log in to post an answer.

Log in